![](https://tusharishtiaq.com/wp-content/uploads/2022/05/150529824_3911999978852651_304667122861458588_n-1024x427.jpg)
ফেব্রুয়ারি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের চিতনা গ্রাম। এক ব্যক্তি মারা গেলে কবর দেওয়া হয় তাঁকে। পরদিন সকালে অদ্ভুত চেহারার এক জন্তুকে সেই কবরের আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখে এলাকাবাসী। কিছুক্ষণের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ল, লাশখেকো একটি জন্তুর খোঁজ মিলেছে।
ব্যাস আর যায় কোথায়! ওটাকে ধরে মহাসমারোহে পিটিয়ে মেরে ফেলল গ্রামবাসী। এতটুকুই তথ্য জোগাড় করেছিলাম পত্রিকা থেকে। যদিও ওখানে প্রাণীটিকে উল্লেখ করা হয়েছিল গন্ধগোকুল বা খাটাশ হিসেবে। তবে জন্তুটির লোমশ শরীর বলছিল অন্য কথা। দেখে একে বিন্টুরং বা ভামের মতোই মনে হচ্ছিল। কিন্তু নাসিরনগরের গ্রামীণ বনে এখনো বিন্টুরং আছে—এটা ভাবতে পারছিলাম না! যা হোক, ওটা বিন্টুরং নিশ্চিত হওয়ার পর কষ্টটা আরও বেড়ে গেল! কেন?
বুনো পরিবেশে যে জন্তুগুলো দেখার আমার বড় ইচ্ছা, তার একটি এই বিন্টুরং বা বাঁশ ভালুক। কেউ কেউ একে বিয়ার ক্যাট বা ভালুক বিড়ালও বলে। এদের আমি একবার দেখেছি, সেটা বন্দী অবস্থায় ঢাকা চিড়িয়াখানায়। বহু বছর আগে। খাঁচায় বন্দী ওই জোড়া বাঁশ ভালুককে অনেকটা সময় দিয়েছিলাম। বেশ স্বাস্থ্যবান ছিল ওই দুটো। এখন আর আছে কি না, জানি না। ড. রেজা খান বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী (প্রথম খণ্ড) বইয়েও ঢাকা চিড়িয়াখানায় দুটো ভাম থাকার কথা লিখেছেন। তবে ওটা আমি দেখার আরও বহু বছর আগের কথা। সম্ভবত ওগুলো আলাদা জোড়া।
এবার নাসিরনগরের ওই ভামকাণ্ডে চোখ বোলানো যাক আবার। ভামরা আমি যত দূর জানি সর্বভুক। কবর থেকে লাশ খাওয়াটা কাগজে-কলমে অস্বাভাবিক নয়। তারপর এদের খাবার বলতে তো আর কিছু নেই। বাধ্য হয়ে এটা ঘটাতেও পারে। তবে ওটা যে আসলেই লাশ খেয়েছে—এমন কোনো প্রমাণও নেই। যদিও গ্রামবাসীরা নিশ্চিত না হয়েই জন্তুটির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। আমরা সত্যি জানি না—যে অপরাধে মারা হয়েছে, সেটা ওই জন্তুটা করেছে কি না?
একটা জন্তুকে তার স্বাভাবিক বাসস্থান থেকে অন্য জায়গায় সরানোটাও তো নিষ্ঠুরতা। আমাদের মানুষদের স্বার্থরক্ষার জন্য সব করতে হবে? অবশ্য একে মারার জন্য অন্তত একটা দোষ আমরা মানুষেরা বের করতে পেরেছি। নিছক খেলার ছলে কিংবা পৈশাচিক আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যেও দেশের এখানে-সেখানে প্রতিনিয়তই মারা হচ্ছে মেছো বিড়াল, চিতা বিড়াল, গন্ধগোকুল, খাটাশের মতো জন্তুগুলো।
ভামের রিপোর্ট সাম্প্রতিক সময়ে এটাই প্রথম। এতেই বোঝা যাচ্ছে, এরা কতটা বিপন্ন। এ কারণেই ছবিটা দেখে বিভ্রান্তও হয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, এরা গ্রামীণ বন থেকে বুঝি চিরতরে হারিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, আর গারো পাহাড়–সংলগ্ন পাহাড়ি বনগুলোতেই আছে এখন—এই ছিল অনুমান।
রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ে এরা এখনো অল্প-বিস্তর হলেও আছে। কালে-ভদ্রে দেখাও মেলে। বান্দরবানের মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের চিড়িয়াখানায়ও একটি বিন্টুরংয়ের ভিডিও চোখে পড়েছিল। নিশ্চয় আশপাশরে কোনো পাহাড়েই ধরা পড়েছিল। ওটার কী খবর এখন বলতে পারব না। খাগড়াছড়িতে কুকুরের আক্রমণে আহত একটি বিন্টুরং ধরা পড়েছিল। পরে অবশ্য ওটাকে আবার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের ক্যামেরা ট্র্যাপে বান্দরবানের সাঙ্গু এবং মাতামুহুরি রিজার্ভে ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়েছে বাঁশ ভালুকের ছবি। এদিকে দুই গবেষক সুপ্রিয় চাকমা এবং হাসান রহমান কাসালং রিজার্ভে গত মার্চেও ক্যামেরা ট্র্যাপে বন্দী করছেন বিন্টুরংদের। এর বাইরে ২০১৭ সালে শেরপুরে একটা বাঁশ ভালুক আটকা পড়েছিল মানুষের হাতে।
কিন্তু এদের সাম্প্রতিক প্রায় সব রেকর্ড পাহাড়ি বনে। একটা বাদে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নাটোরে একটা বাঁশ ভালুক দেখার খবর মিলেছিল। আবার ফিরে আসতে হয় নাসিরনগরের ওই ঘটনায়। বাংলাদেশের গ্রামীণ বনগুলোতে এখনো হয়তো দু-চারটি বিন্টুরং আছে।
কথা হলো নাসিরনগরে তারা এল কীভাবে? নাসিরনগরের সবচেয়ে কাছের সংরক্ষিত বন সাতছড়ি। তাও ওখান থেকে একটি বিন্টুরং অতটা পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে আসাটা স্বাভাবিক নয়! তবে প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক মুনতাসীর আকাশের সঙ্গে কথা বলে জানলাম নাসিরনগরে কিছু বাঁশ বন আছে। আর এটা মোটামুটি জানা যে, বাঁশ ভালুকেরা বাঁশ বন থাকার জায়গা হিসেবে বেশ পছন্দ করে। তাহলে সম্ভবত নাসিরনগরের বাঁশ বাগানই ছিল এর আস্তানা। তবে কি সেখানে আরও আছে? নাকি শেষটাকেই আমরা দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়েছি! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল খান কিন্তু মনে করেন এখনো নাসিরনগরে এদের ছোটখাটো বসতি আছে।
এই নাসিরনগরের বাঁশবনের কথা ভাবতে গিয়েই আমার মনে পড়ল আমার নানার বাড়ি পাশে হবিগঞ্জের মাধবপুরে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হরষপুরে প্রচুর বাঁশ বন আছে। ওই সব বনের দু-চারটায় আমি ঘোরাফেরাও করেছি বেশ। তাহলে ওই বাঁশ বাগানগুলোতেও দু-চারটা বিন্টুরং আছে নাকি! খোঁজ নিতে হবে।
এবার বিন্টুরং জন্তুটি সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলি। বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের জঙ্গলে পাবেন এদের। লোমশ শরীর, গায়ের রং কালো, তবে পা চারটি খাটো। লোমশ লেজটা শুরুর দিকে চওড়া, তারপর ধীরে ধীরে একটু সরু হয়ে শেষ অংশে ভেতরের দিকে কুঁকড়ে গেছে। এই লেজ দিয়ে এরা শক্তভাবে গাছের ডাল বা অন্য যেকোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে। চোখ বড়, গোল কান ছোট। সর্বভুক জন্তুটি খুদে স্তন্যপায়ী জন্তু থেকে শুরু করে পাখি, মাছ, ফলমূল সবই খায়। ডুমুর প্রিয় খাবারের তালিকায় থাকে ওপরের দিকে। শাক-সবজি, লতা-পাতায়ও আপত্তি নেই। তবে এর মড়াখেকো হিসেবে তেমন কোনো পরিচিতির খবর খুব একটা জানা নেই।
শেষটা করতে চাই আশা দিয়ে। নাসিরনগরের এই ভাম হত্যা নিশ্চিত করছে এখনো পাহাড়ি বনের পাশাপাশি গ্রামীণ বনে অল্প হলেও টিকে আছে বাঁশ ভালুকেরা। ২০১৭ সালের দিকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের কাছেও একটি বিন্টুরং ধরা পড়েছিল। শ্রীমঙ্গলের বন্যপ্রাণী সেবা আশ্রমের সজল দেবের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ওটাকে বেদম পিটিয়ে তাদের কাছে আনা হয়েছিল। তবে এখানে চিকিৎসা দিয়ে খুব একটা সুস্থ করতে না পারায় ওটাকে পাঠানো হয় গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। তবে তার ভেতরের ক্ষত এত মারাত্মক ছিল যে, সেখানকার চিকিৎসকেরাও একে বাঁচাতে পারেননি। এভাবে মার খেয়ে মরতে মরতে হয়তো একসময় হারিয়েই যাবে বিন্টুরংয়েরা। আসুন না আমরা একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগেই সচেতন হই, মমতা দেখাই এই বুনোদের প্রতি। পৃথিবীটা তো ওদেরও!
![](https://tusharishtiaq.com/wp-content/uploads/2022/05/safe_image.jpg)