Sponser

হোমসের ২২১ বি বেকার স্ট্রিট

রহস্য
PUBLISHED: May 14, 2022

আজ থেকে প্রায় ৯৩ বছর আগে শার্লক হোমস এবং ড. ওয়াটসনকে নিয়ে লেখা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের শেষ কাহিনিটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু এতো বছরেও শার্লক হোমসের জনপ্রিয়তায় বিন্দু পরিমাণ ভাটা পড়েনি। আমার নিজেরও গোয়েন্দা বইয়ের পোকা হয়ে ওঠার পেছনে অন্যতম অবদান ওই হোমসের। যদ্দুর মনে পড়ে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় সেবার অনুবাদ করা সাইন অব ফোর-এর মাধ্যমে শার্লক হোমস এবং ওয়াটসনের সঙ্গে পরিচয়। অবশ্য এর আগেই তিন গোয়েন্দা দিয়ে রহস্য কাহিনির জগতে ঢুকে পড়া।এখন আমি আপনাদের নিয়ে যেতে চাই ভিক্টোরিয়া যুগের গ্যাস বাতি জ্বলা রাস্তায়, চুপিসারে গোয়েন্দার মতোই হাঁটতে হাঁটতে আতশ কাঁচটা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি এমন একটা স্থাপত্যকীর্তির দিকে, যেটা হোমসের কর্মকান্ডের মতোই রহস্যজালে আবৃত।

হোমস আর ওয়াটসনের আবাসস্থল লন্ডনের ২২১ বি বেকার স্ট্রিট। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের কাহিনিগুলোর কথা বিবেচনা করলে শার্লক হোমস আর জন ওয়াটসন ২২১ বি বেকার স্ট্রিটে ছিল ১৮৮১ থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ১৮৮১ সালে ২২১ বি বেকার স্ট্রিট নামে কোনো অট্টালিকার অস্তিত্তই ছিল না, যেমন ছিল না ১৮৮৭ সালে শার্লক হোমসের প্রথম বই আ স্টাডি ইন স্কারলেট প্রকাশের সময়। তখন বেকার স্ট্রিটের বাড়ির নম্বর কেবল ১০০-পেরিয়েছিল। ওটা ছিল একেবারেই কাল্পনিক এক ঠিকানা। তারপার সময়ের চাকা গড়িয়ে চলে, বেকার স্ট্রিটে নতুন নতুন দালানকোঠা উঠতে থাকে, তারপরই আত্মপ্রকাশ ঘটে ২২১ বি নম্বরটির।এখন যদি লন্ডনে গিয়ে ২২১ বি বেকার স্ট্রিটে হাজির হোন, দেখা পেয়ে যাবেন শার্লক হোমস মিউজিয়ামের, ১৯৯০ সালে শার্লক হোমস ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি যেটার গোড়াপত্তন করে। তবে সত্যি বলতে এমনকী, শার্লক হোমস মিউজিয়ামও ২২১ বেকার স্ট্রিটে অবস্থিত নয়। ওখানে এখনো ২২১ বেকার স্ট্রিট বলতে কিছু নেই। ১৯৩০-র দশকে বিখ্যাত এই ঠিকানাটি ছিল অ্যাবি ন্যাশনাল বিল্ডিং সোসাইটির দালানগুলো নিয়ে গড়ে ওঠা বড় একটি ব্লকের অংশ। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার যেদিন থেকে অ্যাবি ন্যাশনাল আত্মপ্রকাশ করে বলা চলে সেদিন থেকেই, প্রতিষ্ঠানটি কাল্পনিক ২২১ বি বেকার স্ট্রিটে অবস্থান করা সাহিত্যের অমর চরিত্র শার্লক হোমসের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লেখা ভক্তদের অসংখ্য চিঠি পোতে থাকে। সংখ্যাটা এতোই বেশি ছিল যে, তাদের একজন সেক্রেটারি রেখে দিতে হয় হোমসের ক্ষুরধার বুদ্ধির সহায়তা পেতে চাওয়া মক্কেলদের চিঠির উত্তর দিতে।

সবচেয়ে সাধারণ ও পরিচিত উত্তরটা ছিল, হোমস এখন সাসেক্সে অবসার যাপন করছেন। ২৩৯ বেকার স্ট্রিটে এক জর্জিয়ান টাউন হাউসে শার্লক হোমস মিউজিয়াম চালুর পর, সন্দেহাতীতভাবে হোমসের কাল্পনিক ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের সঙ্গে যেটার সাদৃশ্য বেশি ছিল, একটা বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে উঠল দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কারা চিঠিগুলো গ্রহণ করবে? নতুন জাদুঘরটির দাবি হোমস ভক্তদের অনুসন্ধানের জবাব দিতে তারা বেশি দক্ষ, এদিকে অ্যাবি ন্যাশিনালও কল্পলোকের এক গোয়েন্দার দুর্ঘটনাবশত পেয়ে যাওয়া সেক্রেটারির কাজ চালিয়ে যেতে বদ্ধ পরিকর। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলল এই বিতর্ক, সমাধান হতে হতে লাগল সেই ২০০২ সাল, যখন অ্যাবি ন্যাশনাল দালানটা খালি করে চলে গেল। এদিকে রয়্যাল মেইলও তখন ২২১ বি বেকার স্ট্রিটে ঠিকানায় আশা সমস্ত চিঠি জাদুঘরের ঠিকানায় মানে ২৩৯ বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে দিতে সম্মত হলো। হোমসের ফ্ল্যাটের পুরো একটা রেপ্লিকা বহন করা জাদুঘরটি ওয়েস্টমিনিস্টার নগর কতৃপক্ষের বিশেষ অনুমোদনও পেল বাইরে ২২১ বি বেকার স্ট্রিট ফলকটি ব্যবহারের, যদিও এর সত্যিকারের অবস্থান ২৩৭ ও ২৪১-র মাঝখানে। সংক্ষেপে বললে, সত্যিকার শহরের কাল্পনিক এক ফ্ল্যাট বাস্তব হয়ে ধরা দিল, কাল্পনিক একটি ফ্ল্যাটের সত্যিকারের ঠিকানার কাছে সত্যিকার শহরের কাল্পনিক এক ঠিকানা হয়ে। কী আরো তালগোল পাকিয়ে গেল? বিতর্কও কিন্তু এতেই শেষ হলো না। সত্যিকারের ২২১ বেকার স্ট্রিটের অস্তিত্ত্ব না থাকলেও বেকার স্ট্রিটের কোন দালানটাকে ডয়েল হোমস এবং ওয়াটসনের আবাস হিসাবে চিন্তা করে ২২১ বি ফ্ল্যাটটি সৃষ্টি করেছিলেন সেটা নিয়ে গবেষনায় মেতে উঠলেন ঐতিহাসিকরা।

ডয়েলের লেখাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়ে সাহিত্যের ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের অনুপ্রেরণা হিসাবে একাধিক বাড়িকে বাছাই করলেন পন্ডিতরা। যদিও নিশ্চিত কোনো উত্তর পেলেন না তাঁরাও। এমনকী বিখ্যাত ওই ফ্ল্যাটটার নকশা আর সাজ-সজ্জা নিয়েও আছে ধোঁয়াশা। আ স্টাডি ইন স্কারলেট বইয়ে যখন বেকার স্ট্রিটের ফ্ল্যাটটিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো তখনও কিন্তু কামরাগুলো লেখকের খুব একটা মনোযোগ পেয়েছে তা নয়। এক জোড়া বেড রুমের সঙ্গে সুসজ্জিত ও আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে এমন এবং দুটি বড় জানালাসহ একটি বসবার কামরা, মোটামুটি এই উঠে এসেছে বর্ণনায়। পরবর্তীতে হোমসের অন্য কাহিনিগুলোতেও কখনো কখনো বিবরন এসেছে, তবে বেশ কৃপনভাবেই দুই-চার কথায়। তবে এই সামান্য সূত্রগুলো কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে হোমসভক্ত সংগ্রাহকরা ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের আপন আপন সংস্করন তৈরি করেছেন। সন্দেহাতীতভাবেই ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের যে রেপ্লিকাটিতে মানুষ সবচেয়ে বেশি গিয়েছে সেটি বেকার স্ট্রিটের শার্লক হোমস মিউজিয়ামই, প্রকাশিত হোমস কাহিনিগুলোর আদলেই ভেতরটা সাজানো হয়েছে যেখানে। অনেক ২২১বি-র ভীড়ে মিউজিয়াম ফ্ল্যাটটকে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ বলা চলে, কারণ এর দুই তলায় ওয়াটসনের শোবার ঘরটিরও ঠাঁই হয়েছে, যেখানে অন্য রেপ্লিকাগুলোয় কেবল হোমসের বসবার কামরাটা তৈরিতেই নজর দেওয়া হয়েছে। ফায়ারপ্লেসের পাশে হোমসের আর্ম চেয়ারে বসে ছবি তোলার সুযোগও পাবেন, তবে দয়া করে পাইপটা সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলবেন না। জাদুঘর কতৃপক্ষ ছবি তোলার জন্য আপনাকে পাইপ সরবারাহ করবে না। হোমসের জিনিসপত্রগুলো পাবেন ঠিকঠাক জায়গাতেই। ম্যাগনিফাইং গ্লাস, ভায়োলিন, নোটবুক, রাসায়সিক ও ছদ্মবেশ ধরার উপকরণ ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে মিউজিয়ামটি থেকে দৌড়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই লন্ডনের দ্য শার্লক হোমস পাবও। ১৯৫১ সালে একটি এক্সিবিশন উপলক্ষ্যে প্রথম এর সংগ্রহগুলো দাঁড় করানো হয়, এখানকার সংগ্রহের মধ্যে আছে হোমসের বেশ কিছু কাহিনি যে ডেস্ক এবং চেয়ারে বসে লিখেছেন ডয়েল সেগুলোসহ আরো অনেক কিছুই। সুইজারল্যান্ডের মেইরংগেনে দ্য শার্লক হোমস মিউজিয়ামেও পাবেন ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের রেপ্লিকা। সুইজারল্যান্ডোর এক হোটেলে ১৯৬৫ সালে স্থাপিত আরেবকটি শার্লক হোমস জাদুঘরেও স্থান হয়েছে ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের, যেখানে আবার প্রায়ই হাজির হতেন ডয়েলের ছেলে। তবে সবগুলো ২২১ বি তেই একটা বিষয়ে আশ্চর্য মিল, দেখে মনে হবে কেবলই হোমস এবং ওয়াটসন এখান থেকে বেরিয়ে গেছে। কামরার ধোঁয়াটে ভাব দেখে ধারণা করবেন পাইপের ধোঁয়া এখনো বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে, ছড়ানো ছিটানো বই, সংবাদপত্র কিংবা কাপ-পিরিচ দেখে ভ্রম হবে এই মাত্র বুঝি বা কোনো একটা সূত্র কিংবা সন্দেহভাজনের সন্ধান পেয়ে ছুটেছেন গোয়েন্দা। সাগরের ওই পাড়ে আমেরিকার মিনেসোটার উইলসন লাইব্রেরিতেও পাবেন একটি ২২১ বি, সন্দেহ নেই এই বিখ্যাতগুলোর বাইরে হোমস ভক্তদের তৈরি আরো অনেকই ২২১ বি আছে দুনিয়াজুড়ে, তেমনি সিনেমা বা টিভি সিরিজের প্রয়োজনেও বানানো হয়েছে ২২১ বি-র নতুন নতুন সংস্করন।

এখন কেউ যদি বলে বেকার স্ট্রিটে যেসব রেপ্লিকার অবস্থান নয় সেগুলোর কোনো সত্যিকারের ভিত্তি নেই তা যেমন ভুল হবে না অপর পিঠে, বিপক্ষ দলের এটাও বলার সুযোগ আছে ২২১ বি বেকার স্ট্রিট বলে কিছুর অস্তিত্বই নেই এখন, তেমনি কোনো কালে ছিলই না। আসলে প্রত্যেকটি ২২১ বি রেপ্লিকাই কোনো না কোনো দিক থেকে অনন্য। তবে এটাও ঠিক পর্যটকদের আগ্রহটা বেশি বেকার স্ট্রিটের ওই হোমসের আস্তানার রেপ্লিকার দিকেই। এমনকী সত্যজিত ফেলুদাকেও ঘুরিয়ে এনেছেন তার গুরু হোমসের বেকার স্ট্রিট থেকে। শুধু তাই নয়, সত্যজিৎ রায় ফেলুদার আস্তানা হিসাবে ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের অদলেই হয়তো দেখিয়েছেন ২১ রজনী সেন রোডকে। তাহলে হোমস ভক্তরা লন্ডনে গেলে নিশ্চয় বেকার স্ট্রিটে ঢু মারতে ভুলবেন না, আরো একটু কল্পনাপ্রবণ হলে হয়তো নিজেই একটা ২২১ বি বেকার স্ট্রিট তৈরি করে ফেলবেন।সূত্র স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন ও আরো কয়েকটি ওয়েবসাইটছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ

Recommended For You