Sponser

সত্যিকারের শার্লক হোমস

রহস্য
PUBLISHED: May 14, 2022

স্কটল্যান্ডের অ্যার্ডলামন্টের কেসটা আপাতাদৃষ্টিতে ছিল বইয়ের খোলা পাতা পড়ার মতোই সোজাসাপ্টা। অভিজাত, স্বচ্ছল এক যুবা সেসিল হেমব্রাগ অ্যার্ডলামন্ট এস্টেটে শিকারে বেরিয়েছিলেন দুই সহযোগীসহ। এদের একজন তাঁর শিক্ষক আলফ্রেড মনসন। অপর ব্যক্তি এডওয়ার্ড স্কটের পরিচয়টা রহস্যে মোড়া, শুধু এতটুকু জানা গিয়েছিল সে মনসনের বন্ধু। শিকারের এক পর্যায়ে কয়েকটা গুলির শব্দ শুনা গেল। এরপরই কর্মচারীরা মনসন আর স্কটকে অস্ত্র হাতে জঙ্গল থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসতে দেখল। বাটলার যখন জানতে চাইল মি. হ্যামব্রাগের কী হয়েছে, তখন দুজনেই অস্ত্র পরিষ্কারে ব্যস্ত। মনসন দুঃখপ্রকাশ করে জানালেন একটা বেড়া বাইবার সময় দুর্ঘটনাবশত নিজের মাথায় গুলি করেছেন হ্যামব্রাগ। প্রথমে একে দুঃখজনক এক দুর্ঘটনা বলেই ধরে নিলো সবাই। তবে দু-হপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই নাটকীয় মোড় এলো কেসে, আবিষ্কৃত হলেে মারা যাওয়ার কেবল ছয় দিন আগে হ্যামব্রাগ দুটি জীবন বীমা করিয়েছেন। কী আশ্চর্য! দুটোরই নমিনি মনসনের স্ত্রী। মনসনকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো। ইতিমধ্যে বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে স্কট। বিচারের সময় সাক্ষী হাজির করা হলো, তেমনি অ্যালিবাইও তৈরি হলো। শেষ পর্যন্ত জুরিরা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন প্রমাণের ঘাটতি আছে মামলাটিতে, ছাড়া পেয়ে গেলেন মনসন। বিচারের সময় সাক্ষীদের একজন ছিলেন ডক্টর জোসেফ বেল, এডিনবরার এক সার্জন ও ফরেনসিক গোয়েন্দা। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষন ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন এই বেল। কখনো কখনো কেবল তাঁর রোগীদের চেহারা ও আচরণ দেখে পেশা, কোথায় থাকেনসহ নানা ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে চমকে দিতেন ছাত্রদের। বেলের এই ছাত্রদের একজন ছিলেন আর্থার কোনান ডয়েল। এবার আর শার্লক হোমস ভক্তদের এই শল্য চিকিৎসকের পরিচয় উদ্ধার করতে বেগ পাওয়ার কথা না। ঠিক ধরেছেন, ড. জোসেফ বেলের চরিত্রে অনুপ্রাণিত হয়েই স্যার আর্থার কোনান ডয়েল সৃষ্টি করেন তাঁর অসাধারণ চরিত্র শার্লক হোমস। এই বেল সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি বছর পনেরো আগে, প্রথম আলোয় অন্য আলোর একটা ফিচার লিখতে গিয়ে। অবশ্য কল্পকাহিনির আরো অনেক চরিত্রই তৈরি সত্যিকারের কোনো মানুষকে চিন্তা করে। আজ নেটে কিছুটা তালাশ শেষে জোসেফ বেলের সঙ্গে হোমসের সম্পর্কটি আরেকটু পাকাপোক্তভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি।১৮৭৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা মেডিক্যাল স্কুলে জোসেফ বেলের সঙ্গে ডয়েলের পরিচয়। ডয়েল ওখানে ডাক্তারি পড়ছিলেন আর বেল ছিলেন তাঁর শিক্ষকদের একজন। প্রথম যখন তাঁর একটা লেকচার শুনেন ডয়েল তখন বেলের বয়স ৩৯। শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে প্রতিটি কদম ফেলতেন তিনি, এতে প্রচুর শক্তি ব্যায় হয় বলে মনে হতো। চোখ জোড়ায় বুদ্ধির ঝিলিক টের পাওয়া যেত। অসাধারণ একজন শল্য চিকিসক হিসাবে নাম কামালেও বেল ছিলেন শখের লেখক, খেলোয়াড় এবং বার্ড ওয়াচার। ডয়েলের পড়ালেখা জীবনের দ্বিতীয় বছরের শেষ দিকে তাঁকে ওয়ার্ডে একজন সহকারী হিসাবে মনোনীত করেন বেল। তখনই জোসেফ বেলের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ জ্ঞান আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় ডয়েলের। রোগীদের উচ্চারণের সামান্যতম তারতম্য বিশ্লেষণ করে কোন জায়গা থেকে এসেছেন তা নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারতেন বেল। হাতের ত্বক দেখে অনায়াসে অনুমান করে নিতেন তিনি একজন কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি নাকি গির্জার ঘন্টা বাজিয়ে। চলার ধরন থেকে অবলীলায় বলে দিতেন সৈনিক নাকি নাবিক। আবার নাবিক হিসাবে শনাক্ত করে ফেললে শরীরে উল্কির খোঁজ করতেন যেটা বুঝতে সাহায্য করবে ওই নাবিক জাহাজ নিয়ে কোন বন্দরে ভীড়ে।এ প্রসঙ্গে বেলের কাছে আসা এক রোগীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথন বর্ণনা করা যাক।‘তাহলে আর্মিতে ছিলেন?’‘ঠিক, স্যার।’‘বেশিদিন হয়নি অব্যাহতি পেয়েছেন।’‘না, স্যার।’‘পাহাড়ি এলাকার কোনো রেজিম্যান্টে ছিলেন?’‘একদম ঠিক।’‘নন-কমিশনড অফিসার?’‘জ্বী, স্যার।’‘বার্বাডোজে ছিল পোস্টিং?’‘এটাও ঠিক।’পরে অবশ্য বেল এই অসাধারণ বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দেন ডয়েলকে, ‘লক্ষ করে দেখবে, সম্মানিত একজন ব্যক্তি হওয়ার পরও মাথার হ্যাট খুলেননি ভদ্রলোক। সামরিক বাহিনির লোকরা সাধারণত টুপি খুলে না, আবার যদি চাকরি থেকে অনেক আগে অব্যাহতি পেতেন তবে সিভিলিয়ানদের রীতিনীতিতে অভ্যস্থ হয়ে যেতেন। তাঁর আচরণ কতৃত্ত্বপরায়ণ এবং ভদ্রলোক অবশ্যই একজন স্কটিশ, আবার পায়ের গোঁদ রোগটা নিশ্চিত করছে পোস্টিং ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বাডোজে।’খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মানুষটিকে দেখা, রোগীকে পরীক্ষা করা এসবের ওপর গুরুত্ব দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য উপসংহারে পৌঁছাতেন বেল সব সময়। কোনান ডয়েল শার্লক হোমসের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটিয়েছেন। তবে কালজয়ী চরিত্রটি যে অসাধারণ এই প্রফেসরে অনুপ্রাণিত এ নিয়ে কোনো লুকোছাপা করেননি, ‘এতে সন্দেহ নেই যে এ ধরনের একটি চরিত্রের সংস্পর্শে আসার পর, অপরাধীর ভুল নয় বরং নিজের জ্ঞান দিয়ে রহস্য সমাধান করতে পারঙ্গম এমন একজন বৈজ্ঞানিক চিন্তার গোয়েন্দা চরিত্র তৈরির সময় আমি তাঁর কৌশল ব্যবহার করেছি।’প্রফেসরের সঙ্গে কোনান ডয়েলের পরিচয়ের কেবল দশ বছর পর ১৮৮৭ সালে আ স্টাডি ইন স্কারলেটের মাধ্যমে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে শার্লক হোমসের। ১৮৯১ সালে দ্য স্ট্যান্ড ম্যাগাজিনে চরিত্রটিকে নিয়ে ছোটগল্পের প্রথম কিস্তি প্রকাশের পর বৃহস্পতি তৃঙ্গে উঠে যায় হোমসের। বলা চলে, দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খ্যাতি। মজার ঘটনা এই গোয়েন্দায় আগ্রহী ছিলেন স্বয়ং ড. বেলও। এমনকী তাঁর প্রাক্তন ছাত্রকে পরামর্শও দিয়ে ছিলেন কখনো কখনো, যদিও সেগুলো বাস্তব সম্মত নয় মনে করায় সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন ডয়েল। এদিকে হোমসের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেন বেলও। এডিনবরা পুলিশ একপর্যায়ে রহস্য সমাধানে তাঁর সাহায্য চেয়ে বসে। ১৮৮৮ সালে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্য রিপারের তালাশের সময়ও জোসেফ বেলের পরামর্শ নেয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। কথিত আছে বেল এমনকী একজন সন্দেভাজনের নাম জানিয়েছিলও, তবে সেটা জনসমক্ষে আনা হয়নি।তবে বেল কখনোই হোমসের সঙ্গে তাঁকে মিলানোর পক্ষপাতি ছিলেন না। অসাধারণ মস্তিষ্ক ছাড়া বেল এবং হোমসের চরিত্রগত মিলও ছিল কমই। চেহারা-সুরতেও বিস্তার ফরাক ছিল। তা ছাড়া হোমসের মতো অগোছালো ছিলেন না বেল মোটেই। কোকেনে আসক্তি ছিল না তাঁর, তেমনি ভায়োলিনও বাজাতেন না। তাই চরিত্র সৃষ্টির সমস্ত কৃতিত্ব দিয়েছেন ছাত্রকেই। ১৯১১ সালে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান ড. জোসেফ বেল, কোনার ডয়েলের শার্লক হোমসকে নিয়ে শেষ বই প্রকাশের ১৬ বছর আগে। তবে পৃথিবীর মানুষের মনে শার্লক হোমস যতদিন থাকবে ততদিন থাকবেন বেলও।

Recommended For You