Sponser

আমাদের একটা দার্জিলিং আছে

প্রকৃতি
PUBLISHED: May 9, 2022

শুনেছিলাম কেওক্রাডং পাহাড়ের নিচে ছবির মতো সুন্দর, পরিচ্ছন্ন একটা পাড়া আছে, নাম দার্জিলিং পাড়া। গল্প শুনেই অদ্ভুত একটা ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল মনে, অদেখা ওই পাড়ার প্রতি। তবে যে জায়গার নামে এই পাড়ার নাম, সেই ভিনদেশি হিল স্টেশন দার্জিলিংয়ে চলে যাওয়া হয় আগে, সেটা ২০১৭-এ। আর আমাদের নিজেদের দার্জিলিং পাড়ায় পা রাখি, গত বছরের মোটামুটি এই সময়েই।

পাড়ায় পৌঁছানোর আগেই আশ্চর্য এক শীতল হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দেয়। দার্জিলিং পাড়ায় ঢোকার মুখেই দুটো সমাধি ফলক। তারপর কয়েকটি বাড়ি পেরিয়ে চলে আসি মেঘলা দিদিদের কটেজে। অবশ্য পর্যটকদের থাকার কটেজ ও দিদিদের বাড়ি একসঙ্গেই। আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে এখানেই। পাড়া প্রধান সাং সিং বমের মেয়ে মেঘলা দিদি। হাসি-খুশি এক তরুণী। পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধার দেখভাল করেন তিনিই। আমাদের কামরা দুই তলায়। জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে প্রিয় কেওক্রাডং পাহাড়, আর এর গায়ে খেলনা বাড়ির মতো কটেজগুলো।

বিকেলে ও পরদিন সকালে ঘুরে ঘুরে দেখলাম পাড়াটা। যেমন শুনেছিলাম, তেমনি ঝকঝকে-তকতকে একটি পাড়া। পরে জেনেছিলাম পাড়াটা এত পরিচ্ছন্ন থাকার মূলে পাড়া প্রধান সাং সিং বম। বড় উঠানের চারপাশে ছড়ানো বাড়ি-ঘরগুলো অবশ্য সমতলের ছোট্ট কোনো গ্রামের চেহারা দিয়েছে পাড়াটাকে। তবে সে ক্ষেত্রে আপনাকে ভুলে যেতে হবে গোটা পাড়াটাই হাজার দুই ফুট উঁচু সাগর সমতল থেকে, তেমনি ভুলতে হবে চারদিকে একটু দূরে থেকে ঘিরে থাকা উঁচু পাহাড়গুলোকে। খোলা মাঠটার মাঝখানে দাঁড়ালে নাক বরাবর কেওক্রাডং যেন ডাকছিল।

বমরা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। পাড়ার মোটামুটি মাঝখানে একটা বেশ বড় গির্জা আছে। আমরা হেঁটে চলে গিয়েছিলাম ডানে একটা পায়ে চলা পথ ধরে। দু-পাশে ছড়ানো-ছিটানো ঘর, আর একটু এগোতেই দু-তলা এক কটেজে, পর্যটকদের জন্য। সামনেই বাঁশ দিয়ে বানানো বসার চমৎকার জায়গা, ওখানে বসে থাকলাম অনেকটা সময়। 
তারপর গাইড বাবুল ভাইয়ের সঙ্গে চলে এলাম ছোট্ট এক কমলা বাগানে। বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ে কমলা চাষ হয় জানতাম, তবে স্বাদটা যে এতটা দারুণ—এটা টের পেয়েছি এই ভ্রমণে। বগা লেক থেকে দার্জিলিং পাড়া আসার পথে অন্তত ডজনখানকে কমলা গিয়েছে আমার পেটেই। এর মধ্যে আবার দার্জিলিং পাড়ার কমলার আলাদা সুনাম আছে।

ওই রাতে অবশ্য আশপাশের পাহাড় রাজ্য থেকে কোনো বুনো জন্তুর ডাক শুনতে পাইনি। গভীর রাতে একবার বেরিয়েছিলাম বুনোদের দেখতে। তবে চোখে পড়েনি। সকালে সূর্যের মিষ্টি আলো গায়ে মেখে উঠে পড়ি মেঘলা দিদিদের বাড়ির পেছনের পাহাড়টায়, সেখানে আদার চাষ হয়েছে। পাহাড়চূড়ায় পৌঁছে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়, নিচে পাড়াটাকে এখান থেকে আশ্চর্য সুন্দর লাগে পাখির চোখে, বড় মাঠটা ধরে কেওক্রাডং ফেরত পর্যটকদের দেখছিলাম ঠায় দাঁড়িয়ে। 

তারপরই চমকে উঠলাম ঘুরে তাকিয়ে। উঁচু এক পাহাড়, তার গায়ে দীর্ঘ সব বৃক্ষের অরণ্য। হাতের ডানে, একটু ব্যবধান রেখে দাঁড়ানো অপর একটি পাহাড়ও জঙ্গলে ঠাসা। মায়া হরিণ, ভালুকদের ওই দুই পাহাড়ে আস্তানা। মনে মনে হারিয়ে গেলাম বন্যদের রাজ্যে! বেশ কতকটা সময় দাঁড়িয়ে দিশা হারানো মানুষের মতো দেখছিলাম ওই অরণ্য-পাহাড়, তারপর নিচের বম জীবনযাত্রা।

পাড়ার ওপাশে গভীর অরণ্যে ঢাকা পাহাড়

যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছি, এর ঠিক নিচে দিদিদের বাড়ির পেছনটায় ছেলেদের গোসলের ছিল দারুণ ব্যবস্থা। ঝিরি থেকে টেনে আনা শীতল জল শরীরে ঢালতে ঢালতে শিউরে উঠছিলাম, এই পরিবেশে পাহাড় দেখায় সে কী আনন্দে! মনে হয়েছিল, আহ কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেলে কী ক্ষতি হতো! তবে পাহাড়-জঙ্গল ভালোবাসলেও শহরের ব্যস্ততার শিকলে বাধা পড়তে হয়েছে যে আমাদের, হাতে সময় ছিল না বেশি। তা ছাড়া কেওক্রাডংও ডাকছিল!

ওই দেখা যায় কেওক্রাডং

তারপরও পাড়া ছেড়ে যাওয়ার সময় হাসি-খুশি মেঘলা দিদি, পুরোনো দিনের বাঘ শিকারি হাসিখুশি সাং সিং বমের কাছে শোনা রোমাঞ্চকর সব গল্প, মেঘলা দিদির মায়াবতী মা, রাতের বেলা পাহারা দিয়ে আমাদের নির্জন পথে নিয়ে যাওয়া কুকুরটা এবং গোটা পাড়াটার জন্যই মন পুড়েছিল। আশ্চর্য সুন্দর যেখানকার জীবন, এর অধিবাসীদের মতোই নির্মল যার পরিবেশ! 

শেষ করার আগে কয়েকটি কথা ভ্রমণে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখি, বুনো প্রাণকে ভালোবাসি, পাহাড়ের স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রাকে শ্রদ্ধা করি।

Recommended For You