Sponser

জঙ্গলের প্রেতাত্মা

বন্য প্রাণী
PUBLISHED: May 14, 2022

১৯৩৪। ভারতের ব্যাঙ্গালোর (বর্তমান ব্যাঙ্গালুরু) থেকে মাইল পঞ্চশেক দূরে সংরক্ষিত বন লগোয়া একটি গ্রাম শিবানিপল্লি। গভীর অরণ্যের কারণে ছোট্ট গ্রামটার আশপাশ চিতা বাঘদের রীতিমত স্বর্গরাজ্য। তখন সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। গ্রামের এক রাখাল জঙ্গল থেকে গরুগুলোকে চরিয়ে ফিরিয়ে আনবার পথে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয় এক জলাশয়ের সামনে। বেচারার নড়ার ক্ষমতাও ছিল না। ওখানে পানি খাচ্ছে কুচকুচে কালো একটা প্রাণী। এতোদিন সে গল্পই শুনে এসেছিল, আজ দেখল। রাখালের উপস্থিতি টের পেতেই মুহূর্তের মধ্যে এক লাফে পাশের জঙ্গলের অন্ধকারে গা ঢাকা দিল জন্তুটা। গ্রামে এসে যা দেখেছে জানালে, বিশ্বাস করল না কেউই। তবে পরে যখন শিবানিপল্লিও আশপাশের গ্রামগুলোর বনে চরতে যাওয়া গরু মারা পড়তে থাকে বিস্ময়কর প্রাণীটার আক্রমণে, অবিশ্বাসের আর কোনো উপায় থাকল না, গল্পগাঁথার এক কালো চিতাই আস্তানা গেড়েছে শিবানিপল্লির অরণ্যে।
ঘটনাচক্রে ওই সময়ই এক বন্ধুসহ ওই এলাকায় হাজির হোন বিখ্যাত শিকারি কেনেথ এন্ডারসন। এসেই শুনেন কালো চিতার কথা। এর আগে গোটা শিকার জীবনে তাঁর কালো চিতা দেখার অভিজ্ঞতা মোটে একবার। সেটা কাবেরী নদীর কাছে। তখনও সন্ধ্যা ঘনাচ্ছিল। পেন্নাগ্রাম এবং মাতারের মাঝখানে ঢালু একটা রাস্তায় হঠাৎই জঙ্গল থেকে এসে লাফিয়ে পড়ে জন্তুটা। একমুহূর্তের জন্যই দেখেন, তারপরই ওপাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। তো শিবানিপল্লির কালো চিতাটার খবর পেয়ে ওটার পিছু নেন এন্ডারসন। প্রথম মুখোমুখি হোন এক রাতে। টর্চের আলোয় ওটার চোখ জোড়া ছাড়া কিছুই নজর পড়েনি তাঁর। তারপরই জড়িয়ে পড়েন এক রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চারে। তবে সে বর্ণনা দিয়ে এখন বিরক্ত করব না।


বলে নেওয়া ভালো কালো চিতা বা ব্ল্যাক প্যান্থার চিতা বাঘেদের থেকে ভিন্ন কোনো প্রজাতি নয়। ব্ল্যাক ল্যাপার্ড নামেও চেনেন কেউ কেউ। শরীরে মেলানিনের আধিক্য হলে আমাদের গায়ের রং যেমন কালো হয় তেমনি চিতা বাঘেদের মধ্যে মেলানিনের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে ওগুলোর রং কালো হয়ে যায়। তবে এরা চিতা বাঘই, প্রথিবীর দ্রুততম জন্তু চিতা নয়। চিতা নিয়ে পরে কখনো লেখার ইচ্ছা রইল। বিরল হলেও সাধারণ চিতা বাঘেদের একবারে দেওয়া কয়েকটা বাচ্চার মধ্যে একটা কালো হতে পারে। তেমনি কালো চিতার কালো বাচ্চার পাশাপাশি সাধারণ বাচ্চাও হতে পারে। কোনো চিড়িয়াখানায় কাছ থেকে কালো চিতা দেখার সুযোগ হলে কালো পশমের ভেতরে খুব আবছাভাবে চিতা বাঘের সাধারণ চেহারাটাও ও আবিষ্কার করবেন।


চিতা বাঘের মতো জাগুয়ার কালো হলে একেও কিন্তু ব্ল্যকি প্যান্থার বা কালো চিতা বলে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এবং আমাজনের জঙ্গল কিংবা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার অন্য জঙ্গলে কদাচিত কালো চিতা দেখা গেলেও আফ্রিকায় কালো চিতা মহাদুর্লভ। যেমন ১৯০৯ সালে ইথিওপিয়ায় কালো চিতার দেখা পাওয়ার পর গতবছর মানে ২০১৯ সালে আবার কালো চিতার সন্ধান মেলে, সেটা কেনিয়ার একটি সংরক্ষিত জঙ্গলে। কিন্তু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলের চিতা বাঘেদের কালো হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি কেন? বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারেন নি। তবে একটা ধারণা বেশ প্রচলিত। সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে না এমন দুর্ভেদ্য, স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলে যেসব জন্তু বাস করে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গা ঢাকা দেওয়ার প্রয়োজনেই তাদের চামড়া হতে হয় গাঢ় রঙের। এ কারণে এসব এলাকার অন্ধকার, দুর্ভেদ্য অরণ্যগুলোয় বাস করা চিতা বাঘদের মধ্যে কালো চিতার সংখ্যা বেশি। আর আফ্রিকার চিতা বাঘেদের সেখানকার খোলা ঘেসো জমিতে সূর্য্যের আলোয় তাদের আড়ালে রাখতে সাহায্য করে হলদে-কালো চামড়াটাই। মালয়েশিয়ার, বিশেষ করে ক্যানায়ার বন্যপ্রাণী করিডোর এবং বিনটাং হুজাও বন্যপ্রাণী করিডোরে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে এদের। শুনে চমকাবেন, সেখানে বরং সাধারণ চিতা বাঘের চেয়ে কালো চিতাই বেশি। ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে দেখা যায় ওই অরণ্যে প্রতি ৩৩ বর্গ কিলোমিটারে একটি করে কালো চিতার বাস।


এখন মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসাবে বাংলাদেশেও কি কালো চিতা আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটু বছর ত্রিশেক পিছু হটা যাক। সেটা ১৯৮৯ সাল। বাঘ বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরী খবর পেয়েছিলেন বান্দরবানের আলীকদমে বাঘ দেখা গিয়েছে। তবে সেখানে গিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজে বাঘের চিহ্ন না পেলেও রাতের বেলা দেখা পেয়ে যান বাঘের চেয়েও দুর্লভ কালো চিতার, আলীকদম ব্রিজের কাছে। আশ্চর্যজনক ঘটনা এর কাছাকাছি সময়ে কালো চিতা নিয়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে বান্দরবানেরই রেমাক্রিতে। অবশ্য একে ঘটনা না বলে দুর্ঘটনাই বলা উচিত। এর কথা আমাকে বলেছিল বান্দরবানে আমাদের মারমা গাইড। সে বেচারার নাম ভুলে গিয়েছি। বাঘের মতো কোনো জঙ্গলে ঘুরতে গেলে চিতা বাঘ কিংবা কালো চিতার খোঁজ নেওয়াও আমার অভ্যাস। এরকম খোঁজ-খবর নেওয়ার সময়ই ওই গাইড জানায় নব্বই-একানব্বই সালের দিকে রেমাক্রিকে একটা কালো চিতাকে ফাঁদে ধরে ফেলে স্থানীয় অধিবাসীরা। তারপর পিটিয়ে,তীর-ধনুক দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে ওটাকে। যখন মারমা বুড়ো সেই ঘটনা বর্ণনা করছিল তখন আশ্চর্য সুন্দর প্রাণীটার ওই সময়ের যন্ত্রণা যেন দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম, অদ্ভুত একটা কষ্ট দানা বাধছিল মনে। প্রত্যন্ত এলাকার লোকেদের সময় কিংবা দুরত্বের ব্যাপারে উল্টো-পাল্টা ধারণা থাকলেও আমার একবার মনে হয়েছিল খসরু চৌধুরীর দেখা ওই কালো চিতাটাই পাহাড়-নদী ডিঙ্গিয়ে মরতে রেমাক্রিতে চলে যায়নি তো! একটু কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভভ নয়। শুনেছিলাম বেশ অনেক বছর আগে বাংলাদেশের কোনো জঙ্গলে ধরা পড়া একটা কালো চিতা আনা হয়েছিল ঢাকায় আমাদের জাতীয় চিড়িয়াখানায়। তবে সে ব্যাপারে অনেক খোঁজ-খবর নিয়েও তথ্য না পাওয়ায় আপাতত লিখতে পারলাম না। পরে জানতে পারলে শেয়ার করব। যদ্দুর জানি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বাঘ থাকুক না থাকুক চিতা বাঘ অল্প বিস্তর হলেও আছে। এদিকে চিতা বাঘ নিশাচর আর কালো চিতার দেখা পাওয়া রাতের বেলা অসম্ভবের কাছাকাছি, তাই মানুষের হিংস্র দৃষ্টি এড়িয়ে এখনো দু-চারটা বান্দরবান বা রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ি অরণ্যে টিকে আছে এমন আশা করলে কেউ নিশ্চয় দোষ দেবেন না।


কালো চিতা দেখার সৌভাগ্য কিন্তু আমারও হয়েছে। তবে সেটা অরণ্যে নয় চিড়িয়াখানায়। অবশ্য জঙ্গলের মতো এই প্রাণীটি পৃথিবীরে চিড়িয়াখানাগুলোয়ও মোটামুটি দুর্লভ। ২০১৭ সালে গিয়েছিলাম দার্জিলিংয়ে। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত চিড়িয়াখানার মুকুট মাথায় চাপানো পদ্মাজা নাইডু জুওলজিক্যাল পার্কে ঢু মারি। বেশ কতকটা পাকা পাহাড়ি পথ হেঁটে তবেই পৌঁছাতে হয় সেখানে। ভেতরের পথটাও সমতল নয় মোটেই। সেখানেই দেখি ওখানকার অন্যতম আকর্ষন কালো চিতাটাকে। দূর থেকে চেয়ে ছিল আমাদের দিকে। তবে দূর থেকে কালোর আড়ালে এর সত্যিকারের রংটা আবিষ্কার করতে পারিনি। মহা বিপন্ন লাল পান্ডা আর তুষার চিতাও পাবেন ওই জুওলজিক্যাল পার্কটিতে। কাজেই দার্জিলিং গেলে ওখানে যাওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না যেন!


তবে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় কর্নাটকের কাবানি জঙ্গলের একটি কালো চিতা। একে বিখ্যাত বানানোর পেছনে ভূমিকা আবার একজন আলোকচিত্রীর। সাজ জাং নামে এই ফটোগ্রাফার দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ওই কালো চিতাটাকে অনুসরণ করছেন। এর মধ্যে শেষ তিন বছর সকাল ছয়টার থেকে সন্ধ্যা সড়ে ছয়টা পর্যন্ত নিয়ম করে ওই জঙ্গলেই কাটিয়েছেন। ফলাফল কালো চিতাটার দুর্দান্ত কিছু ছবি। তবে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত কালো চিতা মনে হয় রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের জাঙ্গল বুকের মোগলির বন্ধু বাঘিরা, যদিও ওটা বাস্তবের নয় সাহিত্যের কালো চিতা। আঠারো শতকে ইংল্যান্ডের টাওয়ার অব লন্ডনে যে কালো চিতা রাখা হয়েছিল সেটা আনা হয়েছিল তৎকালীন বেঙ্গল থেকে। এদিকে ১৮০৯ সালে ফ্রান্সের এক চিড়িয়াখানায় একটি কালো চিতা আনা হয়েছিল জাভা থেকে।


আমেরিকাতে শুরুতে বসতি স্থাপনকারীরা বিশ্বাস করত অশুভ ডাইনিরা নিজেদের চোখের আড়ালে রাখার জন্য কালো বিড়াল বা কালো চিতার বেশ ধারণ করত। জাগুয়ার বা চিতা বাঘের মতো কালো রঙের ক্যুগার বা পার্বত্য সিংহ দেখার দাবি উঠেছে বিভিন্ন সময়, তবে এ সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় নি।
কোথাও কোথাও নিঃশব্দে, গা ঢাকা দিয়ে চলাফেরার কারনে এরা পরিচিত জঙ্গলের প্রেতাত্মা বা ঘোষ্ট অব দ্য ফরেস্ট নামে। গভীর বনানী আর দুর্গম পাহাড়ে, সবার অগোচরে অশরীরীর মতো চলাফেরা করে নিজেদের মানুষের লোভী চোখের আড়ালে রেখে নিজেদের আরো হাজারো বছর টিকিয়ে রাখুক কালো চিতারা, এই কামনা।
চাইলে এন্ডারসনের লেখা ব্লাক প্যান্থার অব শিবানিপল্লি পড়তে পারেন।
কিংবা আমার রূপান্তর করা জঙ্গলে বিভীষিকা বইটি। যেখানে এন্ডারসনের আরো কয়েকটি কাহিনির সঙ্গে ছায়া চিতা নামে স্থান পেয়েছে শিবানিপল্লির কালো চিতাকে নিয়ে লেখা কাহিনিটিও।
ছবি সাধারণ চিতা বাঘের সঙ্গে একটা কালো চিতা (ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ)

Recommended For You