Sponser

তালতলীর নেকড়ে রহস্য

বন্য প্রাণী
PUBLISHED: May 14, 2022

বরগুনার তালতলীতে মারা পড়েছিল একটি প্রাণী। ছবি দেখে প্রাণিবিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন সেটা নেকড়ে। চমকে যাওয়ার মতো ব্যাপারই বটে। কারণ বাংলাদেশে গত ৮০ বছরেও কোনো নেকড়ে দেখা যায়নি। তবে কি নেকড়ে টিকে আছে বাংলাদেশে? জানার চেষ্টা করেছিলাম।
২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানার কয়েক দিন পর। লাল মিয়া ফরাজীর গোয়াল থেকে একটি বাছুর খোয়া গেল। পরদিন লোকজন পাশের মাঠে আবিষ্কার করল বাছুরটার আধ খাওয়া দেহ। পরের রাতগুলোতে আরো বাছুর আর ছাগল আক্রমণের শিকার হলো। এলাকাবাসী ভয় পেয়ে গেল। ভাবল ফণীর সঙ্গে কোনো বাঘ সুন্দরবন থেকে নদী পেরিয়ে তালতলীতে হাজির হয়েছে। এখন একের পর এক হামলা চালাচ্ছে। এর মধ্যে এক দিন একটা প্রাণীকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে গ্রামবাসী তাড়া করল। তাড়া খেয়ে সেটা লুকিয়ে পড়ে ঝোপের মধ্যে। প্রাণীটা কুকুরের চেয়ে একটু বড়।

পাতা হলো ফাঁদ

শেষ পর্যন্ত গ্রামবাসী বুদ্ধি করে একটা ফাঁদ পাতল। আর এতেই ধরা পড়ল রহস্যময় প্রাণীটা। বোঝা গেল ওটা বাঘ নয়; বরং শিয়ালের সঙ্গে এর বেশ মিল। প্রাণীটাকে গ্রামবাসী পিটিয়েই মেরে ফেলল।

ওটা তবে নেকড়ে

প্রাণীটা মারা যাওয়ার খবর নজরে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশসহ অন্যদের। নড়েচড়ে বসলেন তাঁরা। কারণ প্রাণীটার আক্রমণের ধরন শিয়ালের মতো নয়। এদিকে প্রাণীর ছবিটা খুব স্পষ্ট নয়। একটা সন্দেহ ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে লাগল তাঁদের মনে। যোগাযোগ করলেন বরগুনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদের সঙ্গে। কবীর মাহমুদ দ্রুতই মৃত প্রাণীর বেশ কয়েকটি ভালো ছবি পাঠালেন। প্রাণীটার পা, কানের গঠন আর পেটের কাছের সাদাটে দাগ দেখে গবেষকরা নিশ্চিত হয়ে গেলেন এটা একটা নেকড়ে। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছবি পাঠালেন ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটের এনিম্যাল ইকোলজি বিভাগের প্রধান যাদবেন্দ্রদেব ভি ঝালাকে। ছবি পাঠানো হলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্য প্রাণী সংরক্ষণবিষয়ক কার্যক্রমের জেন এফ কামলারকেও। দ্রুতই তাঁরা নিশ্চিত করলেন প্রাণীটা নেকড়েই। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? বহু বছর তো আর এ দেশে ভারতীয় নেকড়ে দেখাই যায়নি!

ভারতীয় নেকড়ে পরিচিতি

গ্রে উল্ফের একটি উপপ্রজাতি ইন্ডিয়ান উল্ফ বা ভারতীয় নেকড়ে। ব্রিটিশ পক্ষীবিশারদ উইলিয়াম হেনরি সাইকস ১৮৩১ সালে প্রথম এর কথা জানান। আমাদের পরিচিত গোল্ডেন জ্যাকেল বা শিয়ালের সঙ্গে এর বেশ মিল আছে। তবে শিয়ালের শরীর এদের তুলনায় হালকা-পাতলা এবং নাক-মুখ অধিক সরু; অন্যদিকে ইউরোপীয় নেকড়ের তুলনায় আবার ভারতীয় নেকড়ে বেশি হালকা-পাতলা। কালেভদ্রে হলেও কালো নেকড়ে চোখে পড়ে। এমন নেকড়ের দেখা মিলেছিল ভারতের শোলাপুর জেলায় আর ইরানে। সাধারণত ছয় থেকে আটটির ছোট দলে চলাফেরা করে। হরিণ-খরগোশসহ মাঝারি আর ছোট জাতের নানা প্রাণী এদের খাদ্যতালিকায় থাকে। এশিয়ার তুরস্ক, ইরান আর সিরিয়ায় এদের পাওয়া যায়। আছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল আর ভুটানেও। এখনো বেশ ভালো সংখ্যায় আছে ভারতে। ২০০৪ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ভারতে এখন দুই থেকে তিন হাজার ভারতীয় নেকড়ে আছে।

বাংলাদেশে নেকড়ে

যত দূর জানা যায়, ১৯৪৩-৪৪ সালের দিকে নোয়াখালীতে শেষ নেকড়ে দেখা যায়। ওই সময় সেখানে নেকড়ের আক্রমণে একজন মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। তবে অলিভার নামে একজন ব্রিটিশ প্রাণীবিদ ১৯৭৯ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, নেকড়ে চট্টগ্রাম এলাকায় পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করা যায়নি। আর চৌধুরী (১৯৪৪) মত প্রকাশ করছেন—একসময় রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলে সম্ভবত নেকড়ে ছিল। গাজী এস এম আসমত তাঁর ‘বাংলাদেশের বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী’ বইয়ে নেকড়ের পুরনো বাসস্থানের তালিকায় উত্তরবঙ্গের সঙ্গে খুলনাকেও রেখেছেন।

তবে এলো কোথা থেকে?

বাংলাদেশে যদি নেকড়ে এত বছর না-ই থাকবে তাহলে এটা এলো কিভাবে? প্রাণিবিজ্ঞানীরাও এর উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। হতে পারে বহু বছর ধরেই বরগুনা ও আশপাশের উপকূলীয় এলাকার ছোটখাটো বনগুলোতে নেকড়েদের ছোট একটা দল বিচরণ করছে। মানুষ এত দিন এগুলোকে দেখলেও শিয়ালই ভেবে এসেছে। আর রাতে বিচরণ করায় এদের দেখার সুযোগও খুব বেশি নেই। এ বিষয়ে মো. আনোয়ারুল ইসলাম বললেন, ‘আসলে প্রাণীটা একাকী চলাফেরার খবরই পাওয়া যাচ্ছিল। হতে পারে ফণীর সময় সুন্দরবন পেরিয়ে এটা এদিকে চলে এসেছে। যদিও সুন্দরবনের কচিখালী থেকে বরগুনার তালতলীতে আসতে বড় বড় নদী পেরোতে হয়। এটা একটা নেকড়ের জন্য অসম্ভব না হলেও কঠিন। ’ যদি তাই হয় তাহলে কি সুন্দরবনে এখনো বন্য নেকড়ে আছে? যত দূর জানা যায়, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ২০১৭ সালেই একটা নেকড়ের ছবি তোলেন ঋদ্ধি মুখার্জি নামের এক প্রকৃতিবিদ। মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের যাতায়াত আছে। তেমনি কোনো নেকড়ের ওই পথে বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে চলে আসাটা অসম্ভব নয়। ’ তবে এখানেও বড় একটা ঝামেলা আছে। ভারতের সুন্দরবনে নেকড়ের বসতি আছে এমন কোনো প্রমাণ নেই বলে জানিয়েছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বন্য প্রাণী রক্ষক। ধারণা করা হয়েছিল, ঋদ্ধি মুখার্জির দেখা নেকড়েটি অন্য কোনো জায়গা থেকে সুন্দরবনে এসেছে। অবশ্য অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘ভারতের ওড়িশা আর পশ্চিমবঙ্গে নেকড়ে আছে। সেখান থেকে ভারতের সুন্দরবন হয়ে কোনোভাবে তালতলী পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া একটা নেকড়ের জন্য একেবারে অসম্ভব না। ’ তবে সব কিছু মিলিয়ে তালতলীর নেকড়ের রহস্যটা অমীমাংসিতই রয়ে গেল।

তালতলীতে মারা পড়া নেকড়ে (ছবি বরগুনার জেলা প্রশাসকের সৌজন্যে)

২০১৭ সালে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ঋদ্ধি মুখার্জির ক্যামেরায় বন্দি নেকড়ে
Recommended For You