Sponser

৯২ বছরের কিশোর

রোমাঞ্চ
PUBLISHED: May 14, 2022

টিনটিনের সঙ্গে আমার পরিচয়টা কীভাবে তা মনে করার চেষ্টা করছি। তখন থাকি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। ক্লাস সিক্সে পড়ি সম্ভবত। ঢাকায় আমার খালাত ভাইরা বেইলীরোডে যে সরকারী কলোনীতে থাকত সেখানেই থাকত সূর্যরা। তো ওর মা (বাংলাদেশের প্রথম নারী জজ নাজমুন আরা সুলতানা) জেলা জজ হিসাবে বদলি হয়ে এলেন ব্রাক্ষণবাড়িয়া। তখন ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় আমার স্কুলের বন্ধুরা বদে গল্পের বই পড়ার আর খেলার সাথী ছিল অতিরিক্ত জজ আঙ্কেলের তিন ছেলে। তিন ভাইয়ের একজন সুজন ভাইয়ের সঙ্গে খাতিরটা ছিল বেশি। সূর্যরা আসার খবর পেলাম তার কাছেই। ওদের চারপােশে দেয়াল ঘেরা দালানটায় গেলাম দুজন।স্বাভাবিকভাবেই সূর্য আমাকে পেয়ে আহলাদে আটখানা। আসার সময় বলল ওর এখান থেকে যে বইটা পছন্দ হয় পড়ার জন্য নিয়ে যেতে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখছি সুজন ভাই আমাকে তখন চুপিচুপি বলছিল অনেক দিন পর দেখা তো আজ তুমি যে বই চাও ওটাই পাবে।

কয়েকদিন পর কিন্তু বই পেতে পীড়াপীড়ি করতে হবে। আমি সুযোগ বুঝে সম্ভবত গোটা তিনেক বই বাছাই করেছিলাম। ওগুলোর মধ্যে নাম মনে আছে একটারই টিনটিনের বিপ্লবীদের দঙ্গলে। এর আগে টিনটিনের ইংরেজি অনুবাদ দেখেছিলাম নাহিদ ভাইয়ার কাছে। তবে তখন পড়া হয় নি। যাক বাসায় এসে সন্ধ্যার পর পড়ালেখাটা কোনোমতে আম্মুর কাছে দিয়েই বইটা নিয়ে পড়লাম। রুদ্ধশাসে শেষ করলাম দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলের পটভূমিতে টানটান উত্তেজনার সেই কমিকস-অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি। এক বইয়েই কিশোর সাংবাদিক-গোয়েন্দা টিনটিন, তার দুই বন্ধু পাগলাটে-গালির তুবড়ি ছুটানো ক্যাপ্টেন হ্যাডক, ভুলোমনা প্রয়েসর ক্যালকুলাস আর কথা বলিয়ে কুকুর স্নোয়ি বা কুট্টুসের ভক্ত বনে গেলাম।

মজার ঘটনা আজ এতো বছর পরেও টিনটিনের সবচেয়ে প্রিয় বই আমার কাছে বিপ্লবীদের দঙ্গলেই, আর সবচেয়ে নজর কাড়া প্রচ্ছদও আমার দৃষ্টিতে এটিই। প্রথম প্রেম বলে কথা!এরপর টিনটিন পড়া শুরু করেছি যে আর থামি নি। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত টিনটিনের গোটা বাংলা কালেকশনটাই নিজের কাছে নিয়েছি নীলক্ষেতের বদন্যতায়। ওগুলোর বেশ কিছু কিনি সিটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়। সবগুলোই এখন সযতনে আমার সংগ্রহে আছে, স্যরি একটা বাদে!অদ্ভুত ব্যাপার এই আধবুড়ো বয়সেও টিনটিনের বইগুলো আমার আগের মতোই প্রিয়। কেন? লেখা আর আঁকা মিলিয়ে রহস্য-রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার আর কৌতুকের এমন চমৎকার ও স্বার্থক মিলমিশ আমি আর কোথাও পাই নি।

বিপ্লবীদের দঙ্গলের প্রতি টানটা বেশি থাকলেও তিব্বতে টিনটিন, আমেরিকায় টিনটিন, কঙ্গোয় টিনটিন, কৃষ্ণদ্বীপের রহস্য, ফারাওয়ের চুরুট রহস্য-রোমাঞ্চে কোনটা যে কোনটাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলা মুশকিল! বিশ্বাস করবেন টিনটিনের কোনো কোনো কাহিনি পাঁচ-ছয় বার পড়া হলেে দুই তিনটা বই এখনো আমি পড়িনি, বহু বছর সংগ্রহে থাকার পরও, টিনটিন তো আর নতুন করে লিখার সুযোগ নেই তাই ওগুলো জমিয়ে রাখা! অবশ্য অনেক সিরিজের ক্ষেত্রেই আমার এটা করার অভ্যাস আছে।এবার বরং এই অমর কমিক চরিত্র ও বই সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য দেওয়া যাক।বেলজিয়ান আর্টিস্ট জর্জেস রেমি, হার্জ ছদ্মনামে ১৯২৯ সালের ১০ জানুয়ারি বেলজিয়ামের এক সংবাদপত্রের কিশোর সাময়িকিতে প্রকাশ শুরু করেন টিনটিনের প্রথম বই টিনিটিন ইন দ্য ল্যান্ড অব সোভিয়েটস (পরে সোভিয়েত দেশে টিনটিন নামে বাংলা রূপান্তর হয়)। এটা কতটা সাড়া জাগিয়েছে এর প্রমাণ, প্রথম আত্মপ্রকাশের পর এখন পর্যন্ত টিনটিনের ২৪ টি বই অনুদিত হয়েছে সত্তরটির মতো ভাষায়, বিক্রি হয়েছে ২০ কোটি কপির বেশি। নীল আর্মস্ট্রংয়েরও ১৫ বছর আগে ১৯৫৪ সালে চাঁদে যায় টিনটিন। মজার ব্যাপার, টিনটিনকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে অবলীলায় অ্যাডভেঞ্চারে পাঠিয়ে দিলেও ওসব জায়গায় হার্জ নিজে পা রাখেনিনি মোটেই।টিনটিনের বই বলছে টিনটিনের আবাস ছিল ব্রাসেলসের ল্যাব্রাডর স্ট্রিটের এক অ্যাপার্টম্যান্টে। ঠিক এই ঠিকানাটার কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও রাজধানী শহরের ট্যারে-ন্যুভে স্ট্রিটে অনুপ্রাণিত হয়ে এর জন্ম বলে ধারণা করা হয়। টিনটিনের কুকুর স্নোয়ি বা কুট্টুসের নাম হার্জ মূল ফ্রেঞ্চ ভাষায় রেখেছিলেন মেলো, নিজের প্রথম বান্ধবীকে আদর করে এই নামে ডাকতেন হার্জ।১৯৮৩ সালে হার্জ মারা যাওয়ার আগে আমাদের উপহার দিয়ে যান টিনটিনের ২৩ টি জমজমাট অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি। পরে সমাপ্ত করা যাওয়া আরেকটি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি প্রকাশিথ হয়, ১৯৮৬ সালে। এভাবে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ২৪। তবে টিনটিন নিয়ে তার অনেক অপ্রকাশিত ক্যারিকেচার, লেখা মিলে। তিনি মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওগুলো আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়!যা হোক ১৯২৯ সালের ১০ জানুয়ারি টিনটিনের জন্মদিন হিসাবে স্বীকৃত তাই, এখন তার বয়স ৯২। তবে আমাদের পাঠকদের কাছে সে ওই টগবগে কিশোরই।

Recommended For You