Sponser

জিম করবেট: বন্যপ্রাণী ভালোবাসতেন যে শিকারি

বন্য প্রাণী
PUBLISHED: May 8, 2022

এক

এখন থেকে অন্তত এক শ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। ভারতের উত্তরাখণ্ডের কুয়ায়ুনের কালাধুঙ্গির বোর নদীর তীরে বহু পুরোনো এক কাঠের সেতু। এর এক কোণে দেওয়ালে হেলান দিয়ে গল্প শুনছে আট থেকে আঠারো বছরের চৌদ্দজন ছেলে-মেয়ে। গল্প বক্তা ড্যানস নামের এক আইরিশ। সময়টা রাত। তাই চৌহদ্দির জঙ্গল থেকে কাঠকুটো এনে আগুন জ্বেলেছিল খুদে শ্রোতারা। আগুন নিভে গেছে বহু আগে। লালচে আঁচ ঘন অন্ধকারের সঙ্গে লড়াইয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। এই পরিবেশে যে গল্প জমে, তাই বলছে ড্যানশি। ভূতের গল্প। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে ভূত থেকে বানশিতে চলে যায় ড্যানশি। আয়ারল্যান্ডের বানশি। ড্যানশির মতে যা ভূত থেকেও ভয়ংকর। যে চৌদ্দটি ছেলে-মেয়ে গল্প শুনছিল তাদের একজন ছোট্ট করবেট। কালাধুঙ্গি ছিল জিম করবেটদের শীতকালীন নিবাস। আর ওখানে রাতে বানশি, ভারতীয় গ্রামের ডাইনি চুরাইলের গল্প শুনে রোমাঞ্চিত হতো বালক করবেট। করবেটদের পরিবারের গ্রীষ্মকালীন নিবাস নৈনিতাল। কালাধুঙ্গি থেকে যার দূরত্ব মেরেকেটে পনেরো মাইল। নৈনিতালের কথা বললেই অবধারিতভাবে চলে আসে বিখ্যাত নৈনিতাল বা তাল হ্রদের কথা। হ্রদের পাশেই নৈনী দেবীর মন্দির। করবেট লিখে গেছেন মন্দিরের চার মাইলের মধ্যে বাঘ, চিতা বাঘ, সম্বার, ভাল্লুক সবই দেখেছেন। শুধু তাই নয়, এতোটুকুন জায়গার মধ্যে এক শ আটাশ জাতের পাখি চিনেছেন।

দুই

করবেট ও এন্ডারসনের সঙ্গে পরিচয় আমার বলা চলে একই সঙ্গে। ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি। আব্বুর আলমারির নিচের অংশটা বইয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল তখন। মানে আমাদের কোনো বইয়ের আলমারি ছিল না। তো ওই আলমারিতেই খুঁজে পাই সেবা প্রকাশনী থেকে বের হওয়া শিকার ১, শিকার ২, শিকার ৩ এবং জঙ্গল বইগুলো। স্বীকার করতেই হবে অদ্ভুত সুন্দর রূপান্তর করেছিলেন রকিব হাসান। তাই আমার জঙ্গলপ্রেমের সূচনায় তাঁরও ভূমিকা আছে। আমার বালক মনে তখনই শিকারিটির পাকাপোক্ত জায়গা হয়ে যায়। এই মুহূর্তে লিখতে বসে, মাথায় টুপি, রাইফেল হাতে সাদা চামড়ার একজন মানুষকে দেখতে পাচ্ছি মনের চোখে। হিমালয় অঞ্চলের বন-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতেন যিনি। তবে আশ্চর্য ব্যাপার বই পড়তে পড়তে মানুষখেকো কিংবা গোখাদক বাঘ-চিতার বাঘগুলোর প্রতিও আশ্চর্য এক মায়া, ভালোবাসা জন্মায়। বলা চলে করবেটের পাশাপাশি তাঁর প্রতিপক্ষ বুনো প্রাণদেরও ভালোবেসে ফেলি। বিশেষভাবে বলতে হয় মন্দিরের সেই বিশালাকায় বাঘটার কথা। যেটাকে পুরোহিত পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মন্দিরের আশ্রিত বাঘ হিসাবে, করবেট কোনো দিনই তাকে মারতে পারবেন না চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন পুরোহিত। সত্যি করবেট ওটাকে মারতে না পারায় যে স্বস্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে শরীর মনে, তা এখনো অনুভব করতে পারছি যেন। রুদ্রপ্রয়াগের চিতাটার কথা কীভাবে ভুলি। সত্যি মানুষের আশপাশে থাকতে থাকতে মানুষের মতো কখনো আরও বেশি বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছিল ওটা। ধূর্ততা, ভয়ংকরত্বের কাহিনি পড়তে পড়তে শিউরে উঠছি বারবারই। কিন্তু করবেট যখন সত্যি মেরে ফেললেন চিতাটাকে, মনটা কেঁদে উঠেছিল। কেন কে জানে?

তিন

ভারতের হিমালয় এলাকার এক শহর নৈনিতাল। শহরের আকাশ সব সময় থাকে মেঘে ঢাকা। জঙ্গলে নানা বন্যপ্রাণীর আনাগোনা। পাখির কিচিরমিচির। নৈনিতালের উত্তরে তাকালে দেখা যায় হিমালয়ের বরফাবৃত চূড়া। এখানেই জন্ম জিম করবেটের, ১৮৭৫ সালের ২৫ জুলাই। আর এমন জঙ্গুলে এলাকায় যাঁর জন্ম ছোটকাল থেকেই সে বন ভালোবাসবে তাতে আর অবাক হওয়ার কী?। বড় ভাই টমের উৎসাহে শিকারে আগ্রহ হয় জিম করবেটের। দু-ভাই এক সঙ্গে বের হয়ে পড়তেন শিকারে, কালাধুঙ্গির জঙ্গলে। কিশোর বয়সে একাই ফাটা নলের এক বন্দুক নিয়ে বনে ঘুরে বেড়াতেন জিম। নকল করতেন পশু-পাখির ডাক। আয়া খানসামাদের থেকে শিখেন হিন্দুস্তানি আর স্থানীয় পাহাড়ি ভাষা। আর এসব করতে করতে একসময় জাত শিকারি হয়ে উঠলেন জিম করবেট।

চার

ভারতের গাড়োয়াল আর কুমায়ূন এলাকায় মানুষখেকোর উপদ্রব ছিল তখন খুব সাধারণ ঘটনা। কখনো চিতা বাঘ মানুষখেকো হতো। কখনো হতো বা বাঘ। কোনো কোনাটার হাতে এমনকি প্রাণ হারাত শত শত মানুষ। আর এসব মানুষখেকোর পিছু নিতেন জিম করবেট। দিনের পর দিন লেগে থেকে শেষ পর্যন্ত মারতেন মানুষখেকোটাকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচত গ্রামবাসীরা। আর তাই কোণে এলাকায় মানুষখেকোর উৎপাত হলে গ্রামের লোকেরা ছুটে আসত করবেটের কাছে। ১৯০৭ সালে প্রথম মানুষখেকো বাঘ মারেন। ওটা চম্পাবতের মানুষখেকো। নেপাল এবং ভারতের সীমানা ছিল এর রাজত্ব। তারপর মারেন রুদ্রপ্রয়াগের চিতাটাকে। রুদ্রপ্রয়াগ এলাকা হিন্দুদের তীর্থস্থান হিসাবে বিখ্যাত। একজনের পর একজন তীর্থযাত্রী মেরে ভয়ানক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল একটা চিতা বাঘ। ৪০০-এর বেশি মানুষ যায় ওটার পেটে। পানারের মানুষখেকো, মোহন এবং থকের মানুষখেকো বাঘসহ অনেকগুলো বাঘ আর চিতা বাঘ মারেন একে একে। করবেটের কথা গোটা পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে ১৯৪০-সালের পর, যখন বই লেখা শুরু করেন তিনি। তবে অনেক বাঘ মারলেও নিজে বাঘ ভালোবাসতেন করবেট। শুধু তাই না বাঘকে তিনি বলেছেন, ‘বিশিষ্ট ভদ্রলোক’।

পাঁচ

নভেম্বরের শেষ। নৈনিতালে হিম ঠান্ডার কামড় বসাচ্ছে শরীরে। বহু দিনের সঙ্গী রাম সিংহকে তৈরি থাকতে বলেছিলেন করবেট আগে থেকেই। সময়মতো হাজির সে। দেখে সাহেব বারান্দায় পায়চারি করছেন। হাতের টর্চের আলো ফেললেন একটা বস্তার ওপর। ইঙ্গিত পেয়ে রাম সিংহ কাঁধে তুলি নিল ওটা। দেখল বেশ ভারী বস্তা। ওটায় কি আছে জানতে চাইল না একবারও। সঙ্গে আসা একজন লোকসহ অপেক্ষা করতে লাগল, পরের নির্দেশের। জঙ্গলের দিকে ইশারা করলেন সাহেব। তারপর তিন জোড়া পা দ্রুত বেগে চলল জঙ্গলের গভীরে। সূর্যের আলোয় আকাশ হেসে উঠতে কখনো অনেকই দেরি। প্রায় মিনিট চল্লিশেক হাঁটার পর দাঁড়াবার নির্দেশ এলো। বন এখানে অনেক গভীর। আরও ভেতরে একটা ঝোপের মধ্যে আলো ফেললেন। বস্তা খুললেন সাহেব। শাবল, কোদাল, তিনটা রাইফেল আর দুটো শটগান বেরোল ভেতর থেকে। এরই একটা ১৯২৬ সালে মৃত্যু ডেকে এনেছিল রুদ্রপ্রয়াগের চিতা বাঘটার। তাঁর নির্দেশ রাম সিংহরা গর্ত খুঁড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। বেশ গভীর হলে একটা একটা করে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে লাগলেন সেখানে। তবে নামানো আগে পরম ভালোবাসায় চুমু খেলেন প্রতিটি অস্ত্র। হাঁউ মাউ করে কাঁদছে রাম সিংহ। তার মাথায় হাত রাখলেন সাহেব। সালটা ছিল ১৯৪৭। আর নিজের সব অস্ত্র মাটি চাপা দেওয়ার কয়েক দিন পরেই প্রিয় ভারত ছাড়েন করবেট। বড় বোন ম্যাগিসহ চলে যান কেনিয়ায় নিয়েরিতে। সেখানেই মারা যান, ১৯৫৫ সালে।

ছয়জীবনের একপর্যায়ে বন্যপ্রাণী শিকার ছেড়ে আগাগোড়া সংরক্ষক বনে যান করবেট। শেষ মানুষখেকো শিকার করেন ১৯৩৯-এ। এরপর আর কোনো বাঘ বা চিতা মেরেছেন তেমন খবর নেই। জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়েছেন বন্যপ্রাণী রক্ষায়। তাই তো তার নামে গড়ে উঠেছে ভারতের প্রথম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক। আজ থেকে ৬৭ বছর আগে এই দিনে (১৯৫৫ সালের ১৯ এপ্রিল) পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন এই শিকারি ও সংরক্ষক। তাই আজ আমার মনটাও ভার। পুরোনো প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আসছে মনে যে ভারতবর্ষকে এতো ভালোবাসতেন করবেট, সেখান থেকে কেন চলে গেলেন বহু দূরদেশ কেনিয়ায়? ও এই সুযোগে একটা কথা বলে রাখছি কেনিয়ায় রানি এলিজাবেথকে নিয়ে তার চমৎকার একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আছে। ট্রি টপস নামে প্রকাশিত হয়। চাইলে পড়ে দেখতে পারেন। সাতকরবেটের শিকার এলাকা হিমালয় অঞ্চল, করবেট ন্যাশনাল পার্ক, কালাধুঙ্গি, নৈনিতাল কোথাও যাওয়া হয়নি। বছর তিনেক আগে হিমালয়ের ওই দিকটার প্রবেশদ্বার দেরাদুন পর্যন্ত গিয়েই ফিরে এসেছি। হয়তো যাবো কখনো। তখনকার অরণ্য হয়তো পাবো না। তারপরও আমাদের দেশের অরণ্য-পাহাড় থেকে অনেক ভালো আছে সেখানকার অরণ্য-বন্যপ্রাণীরা। করবেটের কথা ভাবতে ভাবতে হয়তো ঘুরে বেড়াব হিমালয় অঞ্চলের জঙ্গল-পাহাড়ে। লেখাটি গত বছরের এই সময়ের। জিম করবেটকে নিয়ে নতুন কিছু লিখার ইচ্ছা থাকলেও সময় স্বল্পতার কারণে এটিই দিত হলো। এই লেখাটি তৈরি করতে আশাপূর্ণা দেবীর জিম করবেট সমগ্র এবং আনন্দবাজারের একটি লেখা থেকে কয়েকটি তথ্য নিয়েছি। তবে অনেক কিছুই নিজের পড়া করবেটের বইগুলো থেকে স্মৃতি হাতড়ে নেওয়া।

Recommended For You