Sponser

ইয়েতি রহস্য

রোমাঞ্চ
PUBLISHED: May 14, 2022

ছোটবেলা থেকেই বরফে মোড়া হিমালয়, এর সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্ট এবং হিলারি-তেনজিং নোরগের দুঃসাহসিক অভিযানের গল্পে মজে গিয়েছিলাম। এর মধ্যেই কীভাবে যেন ওখানকার সবচেয়ে বড় রহস্য ইয়েতিও মাথায় ঢুকে গেল। ব্যাস! ইয়েতির খোঁজে বই-পত্রিকার জগতে চষে বেড়াতে শুরু করলাম। ইয়েতি নিয়ে লিখতে গিয়ে সবার আগে মনে পড়ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পাহাড়চূড়ায় আতংকের কথা। কাঠমান্ডু থেকে ছোট্ট এক বিমানে চড়ে কাকাবাবুর সঙ্গে সন্তু চলে যায় হিমালয়ের দুর্গম এক এলাকায়। আমাদের বাসার ডাইনিং রুমের ছোট্ট খাটটায় শুয়ে ভরদুপুরে, প্রচন্ড গরমের মধ্যেও যেন সন্তুর সঙ্গে শীতে কাঁপছিলাম, কান পাতলেই শুনতে পাচ্ছিলাম হিমবাহ পতনের কান ফাটানো আওয়াজ। কাকাবাবু স্বযত্নে আগলে রাখা ছোট্ট স্বচ্ছ বাক্সের দাঁতটা কি তবে ইয়েতির? বরফের পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া ওই বিশাল ছায়ামূর্তিটা কী? শেষ পর্যন্ত কি ওরা দেখা পাবে ইয়েতির? এমন সব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে উত্তেজনায় টগবগ করছিলাম।

আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বের হওয়া টিনটিন ইন টিবেটের অসাধারণ অনুবাদ তিব্বতে টিনটিনও উঁকি-ঝুঁকি মারছে হাজারো স্মৃতি ঠেলে। এক বিমান দুর্ঘটনায় নিখোঁজ বন্ধুর খোঁজ করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন হ্যাডক ও কথা বলা কুকুর স্নোয়ি বা কুট্টুসকে নিয়ে টিনটিন যায় তিব্বতে। রোমহর্ষক সেই অভিযানের পরতে পরতে ধোঁয়াশা ছড়িয়েছে ইয়েতি।

হিমালয় পর্বতশ্রেণীর বিভিন্ন পাহাড়ে রহস্যময় এক প্রাণীর অস্তিত্ত্বের খবর মেলে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী বিশালদেহী গরিলা সদৃশ, লোমশ এক জন্তু ওটা। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল তিব্বতিরা একে যে নামে ডাকে তার অর্থ, ‘অপরিষ্কার তুষারমানব’। এ নামের সূত্র ধরে পশ্চিমারা একে এবমিনেবল স্নোম্যান বা খারাপ তুষারমানব নামেই চিনতে শুরু করে। গোটা ব্যাপারটাই একটা ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া কিছু নয়। ১৯২১ সালে হেনরি নিউম্যান নামের এক সাংবাদিক এভারেস্ট অভিযান শেষে ফেরা একদল ব্রিটিশ অভিযাত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ওই অভিযাত্রীরা বিশাল আকারের পায়ের ছাপ দেখার বর্ণনা দেন পর্বতের সফেদ শরীরে, জানান গাইডকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে এটা মেতোহ-কাংমি, অর্থাৎ ‘মেন-বিয়ার স্নোম্যান’ এর ছাপ। তবে নিউম্যান মেতোহ-র অর্থ ধরে নিলেন অপরিষ্কার, তার মনে হলো এরচেয়ে এবমিনেবল বা খারাপ তুষার মানবই বেশি ভালো শুনায়, ব্যাস পরিচিতি পেয়ে গেল এবমিনেবল স্নোম্যান নামটি। তবে শেষ পর্যন্ত গোটা দুনিয়াজুড়ে জনপ্রিয়তা পায় নেপালিদের ডাকা নাম ইয়েতি যার অর্থ বড় খাদক। কিন্তু সত্যি কি ইয়েতি আছে? এর উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করব এখন।বেশিরভাগের ধারণা ইয়েতি হিমালয়ের কল্পকথার এক প্রাণী ছাড়া আর কিছু নয়। তবে কিংবদন্তি ও ইতিহাসের পাতা উল্টালে মনে হয় এর অস্তিত্ত্ব থাকলেও থাকতে পারে। কথিত আছে সেই খ্রিষ্ঠপূর্ব ৩২৬ সালেও ইয়েতি রহস্য নাড়া দিয়ে গিয়েছে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে। সিন্ধু নদীর অববাহিকায় এসে ইয়েতির কথা শুনে রহস্যময় প্রাণীটিকে দেখতে চেয়েছিলেন। তখন স্থানীয় লোকেরা জানায়, এত নীচে ওই জন্তুটা বাঁচে না, তাই তাঁর সামনে হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু ইয়েতি আছে এ ব্যাপারে যাঁরা বাজি ধরতে এক পায়ে খাড়া তাদের তুরুপের তাস কী? ওটা কি তবে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ও আলোকচিত্রী এরিক শিপটনের তোলা সেই ছবি।হিমালয়ের সংস্কৃতিতে ইয়েতি জড়িয়ে আছে বহু পুরনো কাল থেকে। তবে একে ইয়োরোপ-আমেরিকার অভিযাত্রীদের সামনে নিয়ে আসেন এরিক শিপটনই। ১৯৫১ সাল, এভারেস্টে আরোহনের একটা বিকল্প পথের খোঁজ করছেলেন শিপটন ও তাঁর দলবল। ওই সময় অপ্রত্যাশিতভাবে অদ্ভুত একটা পায়ের ছাপের সামনে চলে আসেন এবং এর ছবি তুলে নেন। এভাবেই ইয়েতি রহস্য নজর কাড়তে শুরু করে বিশ্ববাসীর। সবচেয়ে বিখ্যাত ও অভিজ্ঞ হিমালয় অভিযাত্রীদের একজন বলে পরিগণিত এরিক শিপটন ছবিটি তুলেছিলেন এভারেস্টের পশ্চিমে মেনলাং হিমবাহে, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০ হাজার ফুট উচ্চতায়। পায়ের ছাপটি ছিল ১৩ ইঞ্চি লম্বা। হিমালয়ে তোলা সবচেয়ে চমক জাগানো ছবিও বলতে পারেন একে। ওই সময় ইয়েতি নিয়ে এতোটাই হৈ চৈ পড়ে যায় যে নেপাল সরকার ১৯৫০-র দশকে ইয়েতি শিকারের লাইসেন্স পর্যন্ত দিয়েছিল। যদিও একটা ইয়েতিকেও জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় জন সমক্ষে হাজির করা সম্ভব হয়নি।

অনেকেই মনে করেন ইয়েতি সাধারণ কালো ভাল্লুক ছাড়া আর কিছু নয়। তবে শিপটনের তোলা ছবিটাকে ফেলা যাচ্ছিল না কোনোভাবেই। ইয়েতির পায়ের ছাপ এমনকী খোদ জন্তুটাকে দেখার দাবি এসেছে যুগে যুগে অভিযাত্রী এবং শেরপাদের কাছ থেকে। এমনকী পশ্চিমা বিশ্বেও এর খবর একটু একটু করে রটছিল। ১৯২৫ সালে এন.এ. টমবাজি নামের এক আলোকচিত্রী এবং রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির এক সদস্য জানান জেমু হিমবাহের কাছে ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় মানবসদৃশ আশ্চর্য এক প্রাণী দেখেছিলেন তিনি হিমালয় অভিযানে। ১৯৪২ সালে দুই পর্বতারোহী তাদের পোয়া মাইল নিচে বড়, কালো দুটো অবয়ব হেঁটে যাওয়ার কথা বলেন। তাদের দাবি সত্যি হলে এগুলোর উচ্চতা নিদেন পক্ষে আট ফুট। এদিকে আরেক অভিযাত্রী ব্রায়ান বার্নি অরুন উপত্যকায় ১৯৫৯ সালে ইয়েতির পায়ের ছাপ আবিষ্কারের কথা বলেন। ইতালিয়ান পর্বতারোহী রেইনহোল্ড মেসনার সম্ভবত ইয়েতিতে সবচেয়ে বেশি মোহিত হওয়া লোকেদের একজন। ১৯৮৬ সালে তিব্বতের কোনো এক জায়গায় প্রথম ইয়েতি দেখেন মেসনার। ওই দিন হাঁটতে হাঁটতে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। অন্ধকার নেমে এলে সামনে কালো, বিশাল এক ছায়ামূর্তি আবিষ্কার করেন। অনেকটা মানুষের মতোই এগুচ্ছিল, তবে আরো দ্রুতগতিতে, শক্তিশালী পদক্ষেপে। ওই রাতে আবারও ওটাকে দেখেন, প্রায় সাত ফুটি এক ইয়েতি। আর এতেই প্রাণীটায় এতোটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন পরের এক যুগের বড় একটা সময় কাটান এর অনুসন্ধানে।তবে এই দীর্ঘ সময়ে অসংখ্যবার হিমালয়ে অভিযান শেষে হতাশাই জুটে কেবল তাঁর কপালে। এমনকী লাসা আর কারাকোরাম এলাকায় আরো কয়েকবার ইয়েতি দেখার সৌভাগ্যের পরও। কারণ শেষমেষ তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান ওগুলো পার্বত্য ভাল্লুকই। এদিকে আর্নস্ট স্ক্যাফের নামের এক জার্মান অভিযাত্রীও ১৯৩৯ সালে জার্মান সরকারের সহায়তায় এক গোপন মিশন থেকে ফিরে একই যবনিকা টানেন ইয়েতি রহস্যের। স্থানীয়দের দাবি জার্মান অভিযাত্রী এমন একটা ইয়েতি গুলি করে মেরেছিলেনও। তবে স্ক্যাফেরের ভাষায় ওটা একটা প্রমাণ সাইজের তিব্বতি ভালুক ছাড়া আর কিছু নয়। ১৯৫৩ সালে স্যার এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে এভারেস্ট অভিযানের সময় বড় কোনো প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখার কথা উল্লেখ করেছিলেন। নোরগেকে তার প্রথম আত্মজীবনীতে ইয়েতির অস্তিত্ত্বে বিশ্বাসী মনে হয়েছিল। লিখেছেন তিনি না দেখলেও তার বাবা রহস্যময় এই জন্তুকে দুই বার দেখেছেন। তবে দ্বিতীয় আত্মজীবনীতে আবার তাকে বেশ সন্দিহান মনে হয়েছে। ১৯৫৪ সালে ডেইলি মেইলের স্নোম্যান অভিযানের সময় একটি গুম্ফা থেকে কোনো প্রাণীর মাথার খুলির কিছু লোমও মেলে, স্থানীয়দের দাবি ওগুলো ইয়েতির লোম। আলোআঁধারিতে একে কালো থেকে গাঢ় বাদামি এবং উজ্জ্বল আলোয় লালচে দেখাচ্ছিল। কিন্তু গবেষনায় উঠে আসে ওটা খুরওলা কোনো প্রাণীর কাঁধের লোম।

এদিকে স্যার হিলারির ১৯৬০ সালের অভিযানের উদ্দেশ্যই ছিল ইয়েতির উপস্থিতির ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা। খুমজাং নামে এক গুম্ফা থেকে স্থানীয়রা ইয়েতির খুলির চামড়া বলে দাবি করা জিনিসটা লন্ডনে নিয়েও আসেন। তবে পরে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হোন ওগুলো অ্যান্টিলোপ জাতীয় প্রাণী সেরোর লোম। এখন দেখা যাক গবেষনা কী মিলেছে? ২০১৩ সালে অক্সফোর্ডের জীন বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান সাইাকস ইয়েতি ভক্তদের ইয়েতির চুল, দাঁতসহ শরীরের অন্য কোনো অংশ হাজির করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন, পরীক্ষার জন্য। পরবর্তীতে যে ৫৭ টি নমুনা পান এর ৩৬ টি বাছাই করা হয় ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। এবার অন্য পরিচিত প্রাণীদের জিনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয় ওগুলো। বেশিরভাগ নমুনাই মেলে ভালুকের সঙ্গে। তবে দুুটি নমুনা, যার একটি পাওয়া গিয়েছে ভূটানে ও অপরটি ভারতে, এমন এক প্রজাতির ভালুকের সঙ্গে মিলে যায়, যেগুলো ৪০-১২০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে! অবশ্য অন্য কয়েকজন বিজ্ঞানী আবার ওই দুটি নমুনা পরীক্ষা করে দাবি করেন ওগুলো সাধারণ ভালুকেরই নমুনা! সর্বশেষ ২০১৭ সালে আরেক দল গবেষক হিমালয় ও তিব্বত থেকে সংগ্রহ করা লোম, মল, দাঁত পরীক্ষা করে জানান ওগুলো তিব্বতি বাদামি ভালুকের নমুনা। গবেষকদের এতো সব যুক্তির পরও কিন্তু ইয়েতি বিতর্ক থেমে নেই। তবে বহু দিন ধরে ইয়েতি সংক্রান্ত কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। এর মধ্যেই গত বছর মানে ২০১৯ সালে ভারতীয় সেনারা হিমালয়ের মাকালু ব্যাস ক্যাম্পে ইয়েতির পায়ের ছাপ খুঁজে পাওয়ার দাবি করার পাশাপাশি এর ছবিও প্রকাশ করে। সঙ্গে সঙ্গে এই নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যায়।

ইয়েতিপ্রেমীদের সাফ কথা এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া যায়নি মানেই তো আর প্রমাণ হয় না ইয়েতি নেই। বরং এটা প্রমাণ করে কতোটা দুষ্প্রাপ্য আর ধূর্ত এরা! ইয়েতি নিয়ে বানানো হয়েছে অনেক সিনেমা, টিভি সিরিজ, ভিডিও গেম এবং কার্টুন ছবিও। শুরুতে যে পাহাড়চূড়ায় আতংক নামে বইটির কথা বলেছিলাম এটা নিয়ে ইয়েতি অভিযান নামে একটি বাংলা সিনেমা তৈরি করেছেন কলকাতার নামী পরিচালক সৃজিত মুখার্জি। ভারত ও সুইজারল্যান্ডে শুটিং করা চলচ্চিত্রটি নেপালী ভাষায় ডাবিং করে মুক্তি দেওয়া হয় সেখানেও। ২০১৭ সালের ঘটনা এটি।ইয়েতি থাকুক না থাকুক, এতে সন্দেহ নেই এটি এখন পরিণত হয়েছে নেপাল, ভারত, ভূটান ও তিব্বত জুড়ে সংস্কৃতি ও ব্যাবসার অনুষঙ্গে। ভূটানে ইয়েতি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ডাক টিকিট। নোপালে অভিজাত, পশ ইয়াক অ্যান্ড ইয়েতি হোটেলে কামরা বুক করতে পারবেন, তেমনি উড়তে পারবেন ইয়েতি এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজেও। গোটা পৃথিবীর কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বুড়ো, কারেরই ইয়েতির প্রতি আগ্রহ কমেনি একটুও। বরং যত দিন গড়িয়েছে রহস্যে যোগ হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা। এমনকী ওই প্রশ্নের উত্তরই যে এখনো পাওয়া বাকি, ইয়েতি আসলে কী?

সূত্র. বিভিন্ন ওয়েবসাইটছবি. শিপটনের তোলা সেই দুনিয়া কাঁপানো ছবি

Recommended For You